ড্রাইভার দাদা - দাদা, গান টা বন্ধ করুন।
আমি - কেন?
ড্রাইভার দাদা - না, মানে এটা তো হাসপাতাল, তাই বলছি।
হাসপাতাল সংলগ্ন সেই বাগান |
এখন তো চারদিক অশান্ত - দেশ জুড়ে ক্যা-এন-আর-সি নিয়ে বিক্ষোভ, এর মধ্যেই গত শনিবার হাসপাতালে গেছিলাম। সেখানে কিন্তু কোনও বিক্ষোভের আঁচ নেই। সেই একদল মানুষের অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার ক্লান্তিহীন প্রয়াস; সেই এমারজেন্সির সামনে যন্ত্রণা-কাতর রোগী ও তাদের আশা-আশঙ্কায় দোলা আত্মীয় পরিজন; সেই করিডর দিয়ে ব্যস্ত যাতায়াত। কোনও ছবি বদলায় নি। দেশের যখন ছয় - সাতটি রাজ্যে ইন্টারনেট স্তব্ধ, প্রায় কার্ফু জারির মতো হাসপাতাল - দেশের সর্বত্র যখন ক্যা ও এন - আর - সি নিয়ে এত বিতর্ক - চায়ের দোকান, সরকারী - বেসরকারী দপ্তর, পাড়ার মোড়ে - ঘরের ভিতর থেকে ব্যস্ত জনপদ সর্বত্র - তার কোন ছাপ হাসপাতালে নেই।
সে চলছে ঠিক আগের মত। সেখানে যারা এসেছে, রোগী- তাঁদের আত্মীয়, হাসপাতাল কর্মী এবং ডাক্তার বাবু - কারো আচরণে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। ঠিক আগের মতোই চলছে সবকিছু।
সে চলছে ঠিক আগের মত। সেখানে যারা এসেছে, রোগী- তাঁদের আত্মীয়, হাসপাতাল কর্মী এবং ডাক্তার বাবু - কারো আচরণে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। ঠিক আগের মতোই চলছে সবকিছু।
এটাই জীবনের বাস্তবতা।
আমার ক্ষেত্রে অবশ্য এই হাসপাতালের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে।
বাবার হাত ধরে ছোটবেলায় আসতাম হাসপাতালে। না ঠিক হাসপাতালে হয়। হাসপাতাল চত্বরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার ঘাটে, সেখানে স্টিমার চলত। খুব সম্ভবত রেল থেকে-ই এই ফেরি পরিষেবা দেওয়া হত। গঙ্গার এপার - থেকে - ওপার যাত্রী পরিবহন। গঙ্গার পাশে-ই আছে ভবতারিণী মা-কালীর মন্দির। তারপর এখানে মাদ্রাসী দোকানে ধোসা - ইডলি খাওয়া। ক্যান্টিন-টি এখনও আছে, মন্দির-টিও, তবে ফেরী পরিষেবা বোধকরি বন্ধ।
সেই ছোটবেলা থেকে এখানে আসছি।
ফুলের সজ্জা |
আমার প্রথম চশমা যে ভদ্রলোক বানিয়েছিলেন - সেই ঘোষকাকুর নাম আজও মনে পড়ে, চেহারাও। প্রবল পাণ্ডিত্য, দক্ষতা আর যত্ন নিয়ে চশমা বানাতেন। বিভিন্ন সময় ছোটখাটো দেহ-মেরামতের জন্য এখানে এলেও, আমরা এই চত্বরে চিকিৎসার জন্য কম আসতাম, বেশী আসতাম সান্ধ্য-ভ্রমণের জন্য। জায়গাটা যে কি পরিপাটি করে সাজান সে আর বলে বোঝাতে পারব না। প্রত্যেক ঋতুতে যথোপযুক্ত ফুলের বাগান, চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঘন সবুজ গালিচা বিছান মাঠ - ভীষণ নিবিড় আনন্দের অনুভূতি দিত এই হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকাটি।
মায়ের কিছু চিকিৎসা এখানে হলেও ( এবং বলা-বাহুল্য প্রতি ক্ষেত্রেই ডাক্তারবাবু - ও - অন্যান্যদের সীমাহীন
যত্ন-পরিচর্যার একাধিক প্রমাণ পেলে-ও ) এই হাসপাতালের মানবিক মুখের অবিস্মরণীয় প্রতিচ্ছবি দেখলুম বাবার মৃত্যুর সময়। একজন সাধারণ রেলকর্মীর জীবনের শেষ-যাত্রা যে বহুলাংশে যন্ত্রণা - বিহীন হয়েছিল, তা এখানকার চিকিৎসক-ও- সকল কর্মীর অনবদ্য প্রচেষ্টার জন্যই সম্ভব হয়। নিজের চোখে দেখেছি, প্রতি ঘণ্টায় বাবাকে দেখে যেতেন ডাক্তারবাবুরা। শেষ কয়েকদিন, প্রায় ২৪ - ঘণ্টা-ই ডাক্তারবাবুরা বাবার দিকে নজর রাখতেন। প্রায় দু-মাস চিকিৎসার পর বাবা ইহ-জগতের সকল দায়ভার মুক্ত হন।
ভাবা যায় না। ভোলা যায় না।
সবচেয়ে আশ্চর্য, বাবার মৃত্যুর পর এখানকার ওয়ার্ড-বয়দের চোখে জল দেখেছিলাম।
সেই ওয়ার্ড-বয় টিকে সেদিন-ও দেখলুম, সেই একই রকম সাজান বাগান, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ! শুধু বাবা আজ আর নেই। কালের নিয়ম মেনেই বাবা এখন আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায়।
পরিশেষে আবার বলি, ড্রাইভার-দাদা যখন বললেন এটা হাসপাতাল, কথাটায় আমার কেমন খটকা লাগল। এটা কি সত্যি হাসপাতাল, অন্তত আমাদের কাছে? বোধহয় না। রেল হাসপাতাল চত্বরের প্রতিটি কোনায় এত স্মৃতি জড়িয়ে আছে - আমার কাছে এটি বোধহয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য স্মৃতিসৌধ।
নাম জানা হয়নি তাহাদের |
No comments:
Post a Comment
Share your love! Share your train of thoughts! I feel great to read your responses!